মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

নফস ও রূহ সম্পর্কে আলোচনা -মারেফতের বাণী / ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল-সুরেশ্বরী


এবার আমরা নফস তথা প্রাণের কথা না বলে রূহ তথা আত্মার কথাটির একটু আলোচনা করতে চাই। বাবা জান শরীফ এই আত্মাকেই তাঁর পুঁথির ভাষায় বলেছেন প্রাণের প্রাণ। তা যে নামেই ডাকা হোক না কেন : আব, পানি, জল আর ওয়াটার আসলে একই পদার্থের অনেক নাম।
কোরান বলছে, ‘কুলুর রূহু মিন আম্‌রি রাব্বি' অর্থা ‘আত্মা আমার রবেরই আদেশ হতে আগত।' অথচ কোরান এই কথাটি কখনোই বলে নি যে ‘কুলুন নফস মিন আম্‌রি রাব্বি' অর্থা ‘নফস তথা প্রাণ আমার রবেরই আদেশ হতে আগত।' তাহলে আত্মা কী? আত্মার মধ্যে রবেরই (আল্লাহ্‌ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি) আদেশ এবং কর্ম বিদ্যমান। নফসের গুণাগুণ কিছুই আত্মার মধ্যে নেই। এই জন্যই আত্মাকে চিনতে এবং বুঝতে পারে না নফস। এমনকি নফস আত্মার ধারণা করতেও পারে না। তাই আত্মা কেবল আত্মাকেই বুঝতে এবং জানতে পারে। ভাষার মাধ্যমে আত্মার পরিচয় দেওয়া যায় না। ভাষার মাধ্যমে রবরূপী আল্লাহ্‌কে যেমন বুঝানো যায় না তেমনি আত্মাকে বুঝানো যায় না। কোরানের বত্রিশ নম্বর সূরা সিজ্‌দাহ্‌-এর নয় আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সুম্মা সাওঅয়াহু ওয়ানাফাকা ফিহি মির্‌রূহিহি' অর্থা ‘পরে পরিপূর্ণ আকৃতি দেন এবং তাঁর (আল্লাহ্‌র) আত্মা তার (মানুষের) মাঝে ফুকার করেন।' এখানেও লক্ষ করার বিষয় হল যে, আল্লাহ্‌ নফস ফুকার না করে আত্মাকে ফুকার করলেন। এই আয়াতটির কথা প্রথমেই বলা হল কারণ এখানেই প্রায় সবাই আত্মাকে নফস বলে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ভুল করে বসেন। আত্মার বিষয়ে যতবার কোরানে বলা হয়েছে তার মধ্যে এটাই একমাত্র বিশেষ ঘোষণা, যার মাধ্যমে মনে হতে পারে যে, সকল মানুষের মধ্যেই আত্মাকে ফুকার করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ্‌ যেহেতু এখানে অকর্তা এবং নির্বিকার সেই হেতু প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে আত্মা আছে সেটা সে বুঝতে পারে না। নিজের মধ্যে নিজের পর্দাটি সরাবার সাধনা এবং রবের রহমত লাভ করতে পারলেই আত্মার পরিপূর্ণ রূপটি নফসের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এবং এই আত্মা প্রতিষ্ঠিত নফসের নামই হল মুমিন। ‘প্রকৃত মুমিন' কথাটি ভুল। কারণ মুমিন মানেই হল আত্মার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা লাভ করা। এই আত্মাকে জানাবার কেবল প্রবল ইচ্ছা ও সাধনার দ্বারা তা হয় না, আল্লাহ্‌র একান- ইচ্ছার উপরই নির্ভর করে। আবার যদি বলা হয় যে নফস আত্মাকে চিনতে পারে না, তাহলেও কথাটিতে ভুল থেকে যায়। কারণ, নফসকে চিনতে পারলেই রবরূপী আল্লাহ্‌কে চেনা হয়ে যায়। সুতরাং নফস আত্মাকে চিনতে পারে না বললে ভুল বলা হয় এবং সেই ভুলটি জেনে শুনেই বলা হয়েছে। কারণ, নফস হল আত্মার বাহন অথবা বসার আসন। নফসটিকে এমন একটি উন্নত স্তরে আসতে হবে, যে স্তরে আসামাত্রই আত্মার বাহন বা আসনে পরিণত হয়ে যাবে। সেই উন্নত স্তর অথবা ধাপটিকে এখন যত প্রকার নামই দেওয়া হোক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ, নামটি এখানে মোটেই মুখ্য নয়। উন্নতির পরিবেশ রচনা করাটাই মুখ্য। অবশ্য এই সামান্য নাম নিয়েও কম মতভেদের সৃষ্টি হয়নি এবং এটা এক ধরনের অজ্ঞতা অথবা গোঁড়ামি বলা যেতে পারে। মান আরাফা রূহু বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে মান আরাফা নাফসাহু, অর্থা যে তার নফসকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু একথা বলা হয়নি যে, যে তার রূহকে চিনতে পেরেছে। অতএব নফস যখন আপনার মধ্যে পরিচয় দান করে সেই পরিচয়টুকুই হল রবরূপী আল্লাহ্‌র পরিচয়। সুতরাং নফস তথা প্রাণই রূহ তথা প্রাণের প্রাণকে চিনিয়ে দেবার আইন আছে বলে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে। যে প্রাণ তার নিজের ভেতর লুকানো প্রাণের প্রাণকে চিনতে পেরেছে সেই প্রাণটি কি পরিশুদ্ধ এবং পরিতৃপ্ত নয়? অবশ্যই সেই নফস তথা প্রাণটি পরিশুদ্ধ এবং পরিতৃপ্ত বলে কোরান ঘোষণা করেছে এবং এই ধরনের প্রাণকে জানড়বাতে প্রবেশ লাভ করার আদেশ দেওয়া হয়। আর জানড়বাতে প্রবেশ লাভ করার অর্থই হল স্বাধীনতা লাভ করা। এই স্বাধীনতার রূপ এবং শক্তি বিজ্ঞানময় এবং রহস্যের এক একটি প্রতিমূতির্  এবং এরাই হাদি, সাদেক, হানিফ, কামেল এবং মুরশিদ। আল্লাহ্‌র বিকশিত অনন্ত ছুটে চলার বিকাশময় রূপের যেখানে ইচ্ছা সেখানেই এদের বিচরণ করার শক্তি রহমতরূপে লাভ করেন। এবং এটাই নানা ভাষায় নানা শব্দের ভঙ্গিতে অফুরন্ত ফয়েজ লাভ করা বলা হয়েছে এবং মর্যাদা অনুযায়ী এদের রূপ ও শান বিচিত্র। সুতরাং এই নফসই আত্মাকে চিনতে পারে, আবার এই নফসই আত্মাকে চেনা তো দূরের কথা ধারণাও করতে পারে না। এই পারে এবং পারে না-টাই আল্লাহ্‌র ইচ্ছার উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল এবং ইহাই আপন আপন তকদিরের রহস্যময় লীলাখেলা। কখনো মনে হয় কথাটি বিরোধের আঁধারে ডুবে আছে, আবার কখনো মনে হয় মিলনের আলোর সাগরে মিলে একাকার হয়ে গেছে। তাই বিরোধ যে পর্যন্ত আছে দর্শনের বিভিনড়বতাও সেই পর্যন্ত আছে এবং থাকবে এবং থাকতে বাধ্য। কারণ, বিরোধ পৃথক করানোর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে এবং এই পৃথক দেখাটাই বহুকে দর্শন করা এবং বহুকে দর্শন করাটাই শেরেক। পক্ষান্তরে মিলনের দর্শনে একেরই দর্শন লাভ হয় এবং সব কিছুতেই একের দর্শন হয় এবং এক ব্যতীত দ্বিতীয় দর্শন আর থাকে না এবং থাকার প্রশ্নই উঠে না। মহা এক শূন্যের গর্তে বহু দর্শনগুলো হারিয়ে যায় এবং হারিয়ে ফেলে সবকিছু। মহাশূন্যবাদের মধ্যেই একটিমাত্র শব্দ ধ্বনিত হয় আর সেটাই হলো : ‘আমিই সত্য', ‘আমিই সুবহানি', ‘আমিই প্রথম মুমিন', ‘আমিই প্রথম', ‘আমিই শেষ', ‘আমিই প্রকাশ্য' এবং ‘আমিই গোপনীয়' ইত্যাদি। মিলনের মহাসাগরে যারা মিশে একাকার হয়ে গেছেন তাদের কথা ও ভাবধারা বুঝতে পারে না তারাই, যারা বিরোধের বিভিনড়বতার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছে তথা বহু দর্শনের মধ্যে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। কারণ, মহা একের মধ্যে মিশে গিয়ে বিরোধকে কথার ভাষায় বুঝানো যায় না। তাই বিরোধের চোখে ও মনে একের কথাগুলো মনে হয় ধাঁধা, এবং অজ্ঞেয়তাবাদ ও সংশয়বাদের দোষে অভিযুক্ত করে বলতে চায় এই আছে এই নেই, থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে, আছে যে তাও বলছি না আবার নেই যে তাও বলছি না। আসলে এটাই বিরোধের আসল রূপ এবং মূল চরিত্র। সুতরাং মিলনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার করে বিজ্ঞ বিচারকের পরিচয় দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু এই আত্মতৃপ্তিই একদিন বিরোধের গলায় ফাঁস হয়ে ফ্রাসট্রেশনের তথা অন্তর্জ্বালার দাহ তুষের আগুনের মত জ্বলতে থাকে মৃত্যু নামক নফসের উপর ঘটনাটি আসার পূর্ব পর্যন্ত। আমরা এখন রূহ তথা আত্মার কথায় ফিরে যাই। আত্মা নিত্য কারণ ইহার শেষ নেই। নিত্য বলতে কী বুঝায়? যা আগে ছিল এবং বর্তমানে আছে এবং পরেও থাকবে, তথা এক কথায়, সব সময় আছে এবং থাকবে। আসলে বর্তমান কালটি পরমাণুর চেয়েও ছোট। ভবিষ্যতের পথ বেয়ে বর্তমানের একটি চমক দেখাবার পরই অতীতের দিকে চলে যায়। একটি বর্তমানের চমকের মধ্যে সমস্ত পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ কোটি কোটি আলাদা চমক দেখিয়ে অতীতের দিকে চলে যাচ্ছে। একটি বর্তমানের চমকের মধ্যে সমস্ত পৃথিবীর জীবজন্তুরা কোটি কোটি আলাদা চমক দেখিয়ে অতীতের দিকে চলে যাচ্ছে। এরকমভাবে সমস্ত আকাশ এবং তার নিচের মধ্যে যা কিছু আছে তারা অগণিত ভিন্ন ভিন্ন চমক বর্তমানকে দেখিয়ে অতীতের দিকে চলে যাচ্ছে। অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, কারো চমকের সঙ্গে অন্য আর একটি চমকের মিল নেই এবং এ রকম অগণিত বিভিন্ন চমক বর্তমানকে একবারই দেখানো হয়। দ্বিতীয়বার সেই একই রকম চমক আর কোনোদিন এবং কোনো কালেও দেখানো হয় না এবং কোনোদিন হতেও পারে না এবং এটাকেই কোরান ‘জুল জালাল' বলে ঘোষণা করেছে।

-মারেফতের বাণী
চেরাগে জান শরীফ ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল-সুরেশ্বরী


1 টি মন্তব্য:

  1. আরে ভাই আমি কিতাব গুলি ডাউনলোড করতে চাই কি ভাবে হবে

    উত্তরমুছুন