মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০১১

বাংলায় সুফিবাদ

বাংলায় সুফিবাদের আবির্ভাবকাল সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এদেশে ইসলামের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়েছে বলে জানা যায়। আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে সুফিরা এসে বঙ্গদেশে সুফিবাদ প্রচার করেন। খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে যেসব সুফি-সাধক এদেশে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: শাহ সুলতান রুমী (রঃ), বাবা আদম শহীদ (রঃ), শাহ সুলতান বলখী (রঃ), শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুতশেকন(রঃ), শাহ মখদুম রূপোশ(রঃ), শেখ ফরিদউদ্দিন শক্করগঞ্জ(রঃ), মখদুম শাহ দৌলা শহীদ(রঃ) প্রমুখ। এঁরা গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলেও কথিত হয়। এঁদের অসাধারণ জ্ঞান, বাগ্মিতা ও মানবপ্রেমের কারণে এদেশের সাধারণ মানুষ সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এভাবে ক্রমশ বঙ্গদেশে সুফিবাদ প্রসার লাভ করে। ১২০৪-৫ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বাংলাদেশ বিজিত হলে ইসলামের শরীআত ও মারিফত উভয় ধারার প্রচার ও প্রসার তীব্রতর হয়। শাসকশ্রেণীর সঙ্গে বহু পীর-দরবেশ এদেশে আগমন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। মুসলিম বিজয়োত্তর যে কয়জন সুফি-দরবেশ ইসলাম ও সুফিবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে শেখ জালালুদ্দীন তাব্রিজি(রঃ), শাহ জালাল(রঃ), শেখ আলাউল হক (রঃ), খান জাহান আলী(রঃ), শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা(রঃ), শাহ ফরিদউদ্দীন (রঃ) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁরা সুফিবাদের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব চমৎকারভাবে তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেন, ফলে বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এই মতবাদ প্রসার লাভ করে। সুফি সাধকদের আগমনের পূর্বে বঙ্গদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরা বসবাস করত। এই দুই ধর্মের গুরু-সাধকগণ আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে দীক্ষা দান করতেন। সুফিগণ ইসলামের মহাসত্যের প্রতি মানুষকে আহ্বান করেছেন প্রেমের মাধ্যমে। মানবপ্রেম তথা সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমার্জন সুফিবাদের মূল আদর্শ। সুফিগণ নিজেদের আদর্শ জীবন এবং সুফিবাদের প্রেম-ভ্রাতৃত্ব-সাম্যের মধুর বাণী প্রচার করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এদেশের সাধারণ মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কিংবদন্তি-পুরুষে পরিণত হয়েছেন। অনেকের মাযার-মাকবারা আছে, যেগুলির প্রতি আজও সব শ্রেণীর মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে; পবিত্র ও পুণ্য স্থান বিবেচনায় এমন কি কেউ কেউ দোয়াদরূদ পাঠসহ নিয়মিত যিয়ারত করে ও পার্থিব কামনা-বাসনায় মানত করে। সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমার্জন সুফিবাদের এই আদর্শের দ্বারা বৈষ্ণবধর্ম, লৌকিক মরমিবাদ, বাউল ধর্মমত ও অন্যান্য ভক্তিবাদ কমবেশি প্রভাবিত হয়। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও সুফিদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন নদী ও সমুদ্রপথে যাতায়াতের সময় মাঝিরা বদর পীরের নাম স্মরণ করে। শুধু তাই নয়, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে শহরের যানবাহনে পর্যন্ত বিভিন্ন পীর-আউলিয়ার নাম লেখা থাকে। লৌকিক ধারার মুর্শিদি-মারফতি গান, গাজীর গান , গাজীকালু-চম্পাবতী কাব্য ও অন্যান্য মরমীসাহিত্য, মাদার পীর ও সোনা পীরের মাগনের গান ইত্যাদি বিভিন্ন পীর-দরবেশকে কেন্দ্র করে রচিত। এভাবে বাংলায় মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈষয়িক জীবনের নানা ক্ষেত্রে সুফিবাদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট/উইকিডিয়া